শফিউল্লাহ সুমন :
পাহাড়, সমুদ্র ও বনাঞ্চল- পর্যটন আকর্ষণের প্রধান এই তিন উপকরণই রয়েছে লাল সবুজের এই দেশে। গত এক দশকে দেশের নৌ, বিমান, রেল এবং সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আন্তর্জাতিক চেইন হোটেলগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অন্যতম একটি খাত হবে পর্যটন। আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলটা বৈশ্বিক পর্যটনের বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের শীর্ষে রয়েছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এশিয়া হবে পর্যটকদের অন্যতম বড় গন্তব্য, তখন পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যটক ভ্রমণ করবে এশিয়া মহাদেশ।
সেই দিক থেকে অপরূপ সৌন্দর্যের আধার বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যের অভাব না থাকার পরও কেন বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে কাঙিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে বার বার হোঁচট খাচ্ছে? এই শিল্পকে ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি কিংবা নানা ব্যক্তি উদ্যোগ। গড়ে উঠছে পর্যটন বিকাশের নানা সংগঠনও। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য, এইসব উদ্যোগ বাস্তবায়নের হার হতাশাজনক। তবে কি পর্যটন বিকাশে সবারই সদিচ্ছার অভাব?
দেশের পর্যটন শিল্পের অভিভাবকের শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ পর্যটন আইন, ২০১০’ এর ধারা-৪ অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা হয়। বোর্ড আছে, অফিস আছে, পরিকল্পনা থেকে মহাপরিকল্পনাও আছে। কিন্তু নেই শুধু বাস্তবায়ন। কিন্তু কেন? ভুলে গেলে চলবে না- পর্যটন একটি বিশেষায়িত খাত। এই খাতের বিপণন, ব্র্যান্ডিং, প্রচার, উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল; যার সত্যি অভাব আমাদের এই শিল্পে।
আজ সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ পড়লেই ভেসে উঠে ভিজিট শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ কিংবা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমণের ফিচার। কেন নেই বাংলাদেশের কক্সবাজার, সুন্দরবন, সিলেটের চা বাগান, শালবন বা পার্বত্য চট্টগ্রামের নয়নাভিরাম দৃশ্য তুলে ধরে বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রচারণা।
পর্যটন বিকাশ নিয়ে কথা বলতে গেলেই প্রথমেই কর্তাব্যক্তিরা বাজেট স্বল্পতার কথা তোলেন। আন্তরিকতা আর সদিচ্ছা থাকলে বাজেট কোনমতেই মুখ্য বিষয় নয়। ইউরোপ-আমেরিকা নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দিকে তাকালেই আমরা খুব সহজেই পর্যটন বিকাশের ধারণা নিতে পারি।
ভারত কিংবা নেপালের প্রতিটি ট্যুরিস্ট স্পটের প্রবেশ মুখেই আমরা দেখতে পাই আই লাভ …..। যেখানে প্রতিনিয়ত পর্যটকরা ছবি তুলে পোস্ট করছেন সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। ব্র্যান্ডিং হচ্ছে স্পট ও দেশ। আগ্রহী করে তুলছে অন্যান্য ভ্রমণপিয়াসীকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলেও সত্য, স্বল্পমূল্যের আই লাভ কক্সবাজার ব্র্যান্ডিংও আমাদের চোখে পড়ে না। বাংলাদেশের অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান দেশের উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্পটগুলোর সৌজন্যে ব্র্যান্ডিং উদ্যোগ নিলেও আমলাতান্ত্রিক বেড়াজালে তা মুখ থুবড়ে পড়ে।
দেশের পাহাড়, নদী, সাগর ও জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি প্রতœতাত্ত্বিক স্থান, মধ্যযুগীয় মন্দির, প্যাগোডা, মসজিদ, গির্জাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান কেন্দ্রিক পর্যটনেরও রয়েছে অপার সম্ভাবনা। বিকাশ লাভ করতে পারে হালাল ট্যুরিজম। বিদেশি পর্যটকদের এখন সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা কমিউনিটি ট্যুরিজমেও রয়েছে বাংলাদেশের শীর্ষে থাকার সুযোগ।
আশার কথা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক নামে তিনটি বিশেষ পর্যটন জোন তৈরির পরিকল্পনা করেছে সরকার। যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বাস্তবায়ন করা গেলে, যা থেকে প্রতিবছর বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পর্যটন প্রচার ও পর্যটন আকর্ষণ বাড়াতে সারাদেশের এক হাজার ২০০টি পর্যটন কেন্দ্র নিয়ে নানা পরিকল্পনা রয়েছে পর্যটন মহাপরিকল্পনায়। এছাড়া অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত উন্নয়ন ও বিপণনের জন্য ১০০টি পর্যটন কেন্দ্র এবং ৫৩টি ক্লাস্টার থেকে ১৯টি ক্লাস্টারকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা পর্যটন বিকাশের পূর্বশর্ত। পর্যটকবান্ধব পরিবেশ পর্যটকদের আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি করে। তাই পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা ট্যুরিস্ট পুলিশকেও ট্যুরিস্টবান্ধব করতে হবে। এজন্য তাদের জনবল বাড়ানো ও দেশি-বিদেশি প্রশিক্ষণ জরুরি।
পর্যটন বিকাশে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কী পরিকল্পনা নেওয়া যায়, কিভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব- তা পর্যটন সংশ্লিষ্ট সবারই কম-বেশি জানা। প্রশ্ন একটাই- সত্যিকার অর্থে সদিচ্ছা নিয়ে বিড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? সেই কর্তাবাবুর অপেক্ষায় আর কতদিন মুখ থুবড়ে থাকবে দেশের ব্র্যান্ডিং ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় হাতিয়ার পর্যটন।