দেশে শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্ধারিত মানদণ্ড তৈরির লক্ষ্যে দেশে প্রথমবারের মতো হতে যাচ্ছে ন্যাশনাল ওয়েজ পলিসি তথা জাতীয় মজুরি নীতি। দেশে ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের আওতায় থাকা ৪৪টি খাতের পাশাপাশি কৃষি, পরিবহন শ্রমিক, বাসাবাড়িতে কাজ করা সব ধরণের অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরাও এর আওতায় আসবে।
এ পলিসি বাস্তবায়ন শুরু হলে দেশের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি, পরিবারের ব্যয়, প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা– এসব বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।
এই পলিসি নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক নেতারা বলছেন, পলিসিটি বাস্তবায়ন হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে যারা এখন উপেক্ষিত কিংবা কম মজুরি পান, তাদের মজুরি বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রায় ৬ মাস আগে ন্যাশনাল লেবার পলিসি করার উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে একাধিক সভা শেষে মন্ত্রণালয় একটি খসড়াও তৈরি করেছে। তবে এখনো শ্রমিকপক্ষ তাদের খসড়া প্রস্তাবনা জমা দেয়নি। শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা চাইছেন আলোচ্য পলিসির আওতায় ন্যূনতম মজুরির বিষয়টিও যুক্ত করতে।
বাংলাদেশ নৌযান শ্রমিক ফেডারেশনের মহাসচিব এবং জাতীয় মজুরি নীতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য চৌধুরী আশিকুল আলম বলেন, “আমরা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একটি ড্রাফট তৈরি করছি। শিগগিরই এই ড্রাফট জমা দেব।”
“আমরা চেষ্টা করবো ন্যাশনাল ওয়েজ পলিসিতে যাতে মিনিমাম ওয়েজ পলিসি যুক্ত করা হয় এবং শ্রমিকরা যাতে বাঁচার মত মজুরি পায়”, বলেন তিনি।
মিনিমাম ওয়েজ পলিসি যুক্ত হলে শ্রমিকদের কী লাভ হবে, এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বর্তমানে এই পলিসি না থাকায় মিনিমাম ওয়েজ বোর্ড মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একেক খাতের জন্য একেক রকম মজুরি নির্ধারণ করছে। কোন খাতের কম ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ হওয়া উচিত– তা উপেক্ষিত থাকছে। কিন্তু মিনিমাম ওয়েজ পলিসি থাকলে এর ভিত্তিতে মজুরি নির্ধারণ করতে হবে এবং ওই মজুরির নিচে কোন খাত মজুরি নির্ধারণ করতে পারবে না।” “এর ফলে শ্রমিকদের মজুরির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বচ্ছলতা আসবে”, বলেন তিনি।
এই কমিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী নভেম্বরের মধ্যে এই ড্রাফট তৈরি হবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মতামত নেওয়ার পর আগামী বছর নাগাদ তা চূড়ান্ত হতে পারে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সায়মা হক বিদিশা এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, “শ্রমিকের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা, মূল্যস্ফীতি, চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে অন্যান্য দেশগুলোতে এই ধরণের পলিসি রয়েছে। আমাদেরও এটা থাকার কথা ছিলো, এতদিন যে ছিলো না, সেটিই বরং অস্বাভাবিক।”
তিনি বলেন, “এই পলিসি বা মিনিমাম ওয়েজ শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রেখে স্বাধীন কমিশনের কাছে থাকা উচিত এবং সেখানে সব পক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে তা নির্ধারণ করা উচিত।”
বাংলাদেশে বর্তমানে কোন ধরণের মজুরি নীতি নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ ২০১৭ সালের লেবার ফোর্স সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, যাদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন মজুরি কাঠামো নেই।
এছাড়া প্রায় এক কোটি শ্রমিক আছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে। প্রতিষ্ঠাানিক খাতের শ্রমিকদের মধ্যে ৪৪টি খাতের শ্রমিকদের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন মিনিমাম মজুরি বোর্ড কর্তৃক মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে কোন কোন খাত আছে যেখানে ১৯৮৭ সালের পর আর নতুন মজুরি নির্ধারন করা হয়নি। মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পেট্রোল পাম্পের শ্রমিকদের মজুরি ১৯৮৭ সালের পর আর নির্ধারণ হয়নি, এবং এই মজুরির পরিমাণ মাসে মাত্র ৭৯২ টাকা।
অবশ্য মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, আলোচ্য খাতসহ ১৫টি খাতের নতুন মজুরি নির্ধারণের কাজ বর্তমানে চলমান।
মিনিমাম ওয়েজ বোর্ডের সচিব ও জাতীয় মজুরি নীতি সংক্রান্ত কমিটির সদস্য রাইসা আফরোজ বলেন, “নতুন পলিসি বাস্তবায়ন হলে মজুরি নির্ধারণের কিছু অসঙ্গতি কমে আসবে।” মন্ত্রণালয় একটি খসড়া তৈরি করেছে বলে জানান তিনি।