দেশের রিজার্ভ বাড়ানোর প্রচেষ্টায় এবার প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের জন্য ব্যাংকগুলোকে ডলারপ্রতি ২.৭৫ টাকা অতিরিক্ত প্রণোদনা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে সরকার। চলমান ডলার সংকটের মাঝে গত ৪১ মাসের মধ্যে গেল সেপ্টেম্বরে দেশে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স আয় হয়েছে।
সরকারের দেওয়া এই ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা পর এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে টাকা পাঠালে ডলারপ্রতি ১১৫.৫০ টাকা করে পাবেন প্রবাসীরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এবং বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) শুক্রবার (২০ অক্টোবর) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে এক জরুরি বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়। সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাশরুর আরেফিন বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সভায় উভয় সংগঠনের নেতারা জানান, এখন থেকে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের জন্য ডলারপ্রতি পূর্বনির্ধারিত ১১০ টাকা বিনিময় হারের ওপর আরও ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দিতে পারবে।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অতিরিক্ত প্রণোদনার এই খরচ মেটাতে ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল অথবা কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ড ব্যবহার করতে পারবে।
এদিকে, বিদেশি মুদ্রা ব্যবহার করে অন্যান্য বিল পরিশোধ যেমন– আমদানি বিল নিষ্পত্তি, বহির্মুখী রেমিট্যান্স, ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট এবং স্টুডেন্ট ফাইল সেটেলমেন্টের জন্য প্রতি ডলারের দাম ১১০.৫০ টাকায় অপরিবর্তিত রয়েছে। অর্থাৎ, এক ডলারের ক্রয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে পার্থক্য হবে ২.২৫ টাকা। কারণ এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত চার্জ আরোপ বা ক্রয়মূল্যের সাথে সামঞ্জস্য করার সুযোগ পাচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্সের জন্য এক ডলারের বিপরীতে ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ ১১০ টাকা এবং আমদানির জন্য ১১০.৫০ টাকা করে দিতে পেরেছে।
সেপ্টেম্বরে অভ্যন্তরীণ রেমিট্যান্সের প্রবাহ হ্রাস পেয়ে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ২০২০ সালের এপ্রিলের পর থেকে সর্বনিম্ন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সপ্তাহ দুই আগে ‘উচ্চ হারে ডলার অর্জনের জন্য’ ব্যাংকগুলোকে মৌখিক নির্দেশনা দেয়।
গত সপ্তাহে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈঠকেও এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
তা সত্ত্বেও, কিছু ব্যাংক এই অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে উচ্চ হারের প্রস্তাবে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর আরোপিত সম্ভাব্য জরিমানার কারণেই এ নির্দেশনা মানতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তারা। গত বছরের মে থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত দুইবার এমন জরিমানার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি, রেমিট্যান্সের জন্য অতিরিক্ত হারের অভিযোগে ১০টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রধানকে জরিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ফলস্বরূপ, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ডেপুটি গভর্নরের মৌখিক আদেশ সত্ত্বেও, কিছু ব্যাংক রেমিট্যান্সের জন্য উচ্চ হারের এই অনুমতি মানছে না বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন ট্রেজারি কর্মকর্তা।
এরপরেও প্রশ্ন থেকে যায়– এবার কি রেমিট্যান্স বাড়বে?
ব্যাংকাররা ইতোমধ্যেই এ বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন: কেউ কেউ সিদ্ধান্তটিকে সাধুবাদ জানিয়েছে, আবার অনেকে এটিকে ‘পরিকল্পনাহীন কিংবা অবাস্তব সিদ্ধান্ত’ হিসাবে উল্লেখ করছেন।
ব্যাংকাররা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশ পাওয়ার আগে থেকেই অনেক ব্যাংক রেমিট্যান্সের জন্য ডলারপ্রতি ১১৫-১১৬ টাকা করে অফার করছে। যদিও এবিবি এবং বাফেদা আনুষ্ঠানিকভাবে রেমিট্যান্সের জন্য অতিরিক্ত ডলার হার অনুমোদন দিয়েছে, তারপরেও এটি বর্তমানে এসব ব্যাংক প্রদত্ত প্রচলিত হারের তুলনায় কম।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি কর্মকর্তা বলেন, “এই রেট হুন্ডির রেটের তুলনায় কম; হুন্ডিতে প্রতি ডলারে প্রায় ১২০ টাকা মিলছে।”
এদিকে, আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির রেট এখনও স্পষ্ট করেনি এবিবি এবং বাফেদা। ফলে এ নিয়ে কিছুটা চিন্তিত ব্যাংকাররা।
একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলো বেশি দরে ডলার কিনবে এবং কম দরে বিক্রি করবে। এই পদ্ধতি কতটা বাস্তবসম্মত সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, “বিনিময় হারের লোকসান কেন আমরা গ্রহণ করব? লোকসানের উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবসা করা হয় না; মনে হচ্ছে এটি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের মুনাফা থেকে সিএসআর রাখা হয়। এই তহবিলের টাকা স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল এবং জলবায়ু খাতে ব্যয় করা হয়। এবিবি ও বাফেদা এই তহবিল থেকে বিনিময় হারের লোকসান পূরণ করতে বলছে।
“তাহলে এই ডলার কি জনকল্যাণে ব্যয় করা হচ্ছে?,” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
হুন্ডির চাহিদা
গতবছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড সংখ্যক শ্রমিক বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেও দেশে রেমিট্যান্স বাড়ছে না সেই অনুপাতে। গত ৪১ মাসের মধ্যে গেল সেপ্টেম্বরে দেশে সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে।
ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, দেশের বাইরে যাওয়া শ্রমিকের সংখার তুলনায় রেমিট্যান্স না বেড়ে, বরং কমছে। দেখা যাচ্ছে, দেশে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরোক্ষ নির্দেশনায় এবিবি ও বাফেদা ডলারের দাম বাড়ালেও হুন্ডির চাহিদা খুব একটা কমবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা
একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের এমডি বলেন, বাজারের ওপর ভিত্তি করে ডলার দাম নির্ধারিত হলে হুন্ডির চাহিদা কমবে; কারণ ডলারের দাম বাড়লে হুন্ডির ডলারের দামও বেড়ে যায়, ফলে চাহিদা কমে।
“আবার ডলারের রেট কম থাকলে হুন্ডির রেটও কম থাকে, তাই হুন্ডির চাহিদা বাড়ে। অন্য কথায়, ডলারের রেট কম রাখার অর্থ হলো হুন্ডির চাহিদা বাড়ানো,” যোগ করেন তিনি।
আরেক ব্যাংকের এমডি বলেন, “হুন্ডি কমাতে দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, যারা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের রেট অবশ্যই বাজার-ভিত্তিক হতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম ধরে রেখে হুন্ডি কোনোভাবেই কমানো যাবে না।
হুন্ডি কমিয়ে ডলার প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে ডলারের দাম নির্ধারণের স্বাধীনতা দেওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যেভাবেই হোক আমাদের ডলার ইনফ্লো বাড়াতে হবে। ডলারের মূল্য ধরে রাখা ঠিক হবে না।”