সুনায়রা শিনঝিরি :
ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (ডিপিআই) এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন ডিজিটাল বিশ্ব গড়তে ১০ দফার ‘ঢাকা সনদ ২০২৩’ ঘোষণা করলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এর মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি। ঘোষিত সনদে বলা হয়েছে- ডিজিটাল অভিগম্যতায় সমতা আনয়ন; ডিপিআই ও এআই এর শক্তিকে ত্বরান্বিতকরণ; বৈশ্বিক সুবিধার জন্য দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার; বৈশ্বিক অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়, অংশীদারিত্ব ও জোট গড়ে তোলা; নর্থ-সাউথ, সাউথ-সাউথ-নর্থ ট্রায়াংগুলার সহযোগিতা; শিক্ষা এবং ডিজিটাল স্বাক্ষরতা; ইনক্লুশন ফর ফ্রুগাল ইনোভেশন; আর্থিক অন্তর্ভুক্তি; দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য প্রযুক্তিগত ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি এবং জেন্ডার ইনক্লুশন।
মঙ্গলবার দুই দিনের ‘ডিপিআই অ্যান্ড এআই ফর জিরো ডিজিটাল ডিভাইড’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে ‘ঢাকা সনদ ২০২৩’ ১০ দফা সনদের বিস্তারিত তুলে ধরেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী। রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সমাপনীতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এর মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি এর সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী ডা: দীপু মনি, এমপি; বিশ্ব ব্যাংক, ইউনেস্কো, ইউএনডিপিসহ দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ এবং দেশের প্রযুক্তি খাতের ৫ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
শিক্ষামন্ত্রী ডা: দীপু মনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে শিক্ষার ডিজিটালাইজেশনে বিপ্লব এসেছে। শিক্ষাখাতে প্রযুক্তি প্রসারের মাধ্যমে আমরা স্মার্ট সিটিজেন তৈরি করছি। গতানুগতিক শিক্ষাকার্যক্রম থেকে আধুনিক শিক্ষায় রূপান্তরের কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। আমরা ইতোমধ্যে ব্লেন্ডেড শিক্ষার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এর মাধ্যমে আমরা সমৃদ্ধ শিক্ষা নিশ্চিতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছি। এর মধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম এমনভাবে ডিজাইন করছি, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। এছাড়া শিক্ষা কার্যক্রমকে আরও প্রযুক্তি নির্ভর করার জন্য ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ‘নৈপুণ্য অ্যাপ’ উদ্বোধন করেন। জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২২ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন রেকর্ড সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রতিবেদন তৈরি স্মার্ট ও সহজ করতে তৈরি করা হয়েছে এই নৈপুণ্য অ্যাপ। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা ও পারদর্শিতার অবস্থা জানতে পারবেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকরা। আগামীর সমৃদ্ধ শিক্ষা বাস্তবায়নে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবনী উদ্যোগ তৈরি করে স্মার্ট শিক্ষা নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক সহায়তার আহ্বান জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার চেষ্টা করছি। এছাড়া শিক্ষাখাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর নতুন নতুন স্মার্ট উদ্ভাবনে জোর দিচ্ছি। দেশ ও বিশ্বব্যাপী স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বৈষম্যহীন ও টেকসই বিশ্ব গড়তে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। আমরা আশা করছি, ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে আমরা বিশ্বে অবদান রাখতে পারবো।
ডিপিআই ও এআই নিয়ে ঢাকা সনদ-২০২৩ তুলে ধরে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক বলেন, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ফলে তথ্যপ্রযুক্তির আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও বিকাশে অবদান রাখবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে ডিপিআই এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন ও বৈষম্যহীন ডিজিটাল বিশ্ব গড়ার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। এই আয়োজনের মাধ্যমে দেশের ডিজিটাল সেবায় নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে আশা করছি। জনবান্ধব এআই-নির্ভর অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা আগামীতে আমাদের নাগরিক সেবাগুলোকে আরো সার্বজনীন করার চেষ্টা করবো। আমাদের অর্জন ও অভিজ্ঞতাকে শাণিত করতে প্রতি বছর ‘ডিপিআই অ্যান্ড এআই ফর জিরো ডিজিটাল ডিভাইড’ আয়োজন করা হবে।
আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনের সমাপনী দিনে ই-কমার্স খাত, ফিনটেক, পাবলিক সার্ভিস ডিজিটাইজেশন, এডুটেক, স্বাস্থ্যসেবা, গ্রীন ইকোসিস্টেম উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সর্বোত্তম ব্যবহার বিষয়ক ৬টি সেশন/সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশ ও বিশ্বব্যাপী ই-কমার্স খাত সম্প্রসারণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধ অর্থনীতি গড়ার ক্ষেত্রে ফিনটেক, স্মার্ট নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা পারসোনালাইজড সল্যুশন তৈরি করা, আগামীর সমৃদ্ধ শিক্ষা বাস্তবায়নে উদ্ভাবনী উদ্যোগ তৈরি করে স্মার্ট শিক্ষা নিশ্চিত করা, স্মার্ট ও টেকসই স্বাস্থ্যব্যবস্থা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এবং সবুজায়ন ও টেকসই বিশ্ব তৈরিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন, বণ্টন এবং ভোগের নকশা উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সম্মেলনের সমাপনী দিনে ডিজিটাল বৈষম্য শূন্যের কোটায় নামিয়ে এনে টেকসই আগামীর স্মার্ট বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম ব্যবহার, নীতি ও নৈতিকতা নির্ধারণ, বাস্তবায়ন ও পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
দুই-দিনব্যাপী এই সম্মেলনে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ ও স্মার্ট বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে সেক্টরভিত্তিক ১৪টি বিশেষ সেশন অনুষ্ঠিত হয়। দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা উক্ত সেশনগুলোতে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাপী ডিপিআই ও এআই-এর সম্ভাবনা নিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি খাতের উচ্চ-পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করার পাশাপাশি ডিজিটাল অভিগম্যতার সাথে ডিপিআই এর রূপান্তর, দায়িত্বশীল এআই-এর জন্য টেকনোলজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, ডাটা সিকিউরিটি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, জিরো ডিজিটাল ডিভাইড এর জন্য বৈশ্বিক সমন্বয় এই সম্মেলনের লক্ষ্য। সম্মেলনে ডিপিআই ব্যবস্থা নির্মাণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমিয়ে এনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা করেন বিশেষজ্ঞরা।
সমাপনী অনুষ্ঠানে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিপিআই এর সর্বোত্তম চর্চার ওপর আলোকপাত করেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও স্মার্ট বাংলাদেশ নেটওয়ার্কের ভাইস-চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। প্রযুক্তিখাতের নেতৃবৃন্দ, সরকারের বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধি এবং শিক্ষাবিদদের নিয়ে প্রশ্নোত্তর পর্বে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন-আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক, বিসিএস সভাপতি সুব্রত সরকার, বেসিস পরিচালক আহমেদুল হক বাবু, ই-ক্যাব সভাপতি শমী কায়সার, বাক্কো’র অর্থ সম্পাদক মোঃ আমিনুল হক এবং অ্যামটব মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার। ইউএনডিপি বাংলাদেশ-এর আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলার, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আব্দুল্লাই সেক এবং আইসিটি সচিব মোঃ সামসুল আরেফিন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মালেকা খায়রুন্নেছা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডর চেয়ারম্যান প্রফেসর আজাদ হোসেন চৌধুরী ও অনুজীব বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা আলোচনায় অংশ নেন। এছাড়াও বিশ্বয়ানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজনীয়তা ও প্রভাব নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন ইউনেস্কোর সহকারী মহাসচিব গ্যাব্রিয়েলা রামোস এবং ইউএনডিপি’র চিফ ডিজিটাল অফিসার রবার্ট ওপ।
এসময় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি খাতের নেতৃবৃন্দ, একাডেমিয়া, উদ্যোক্তা এবং দেশ-বিদেশের আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞসহ তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ এবং এটুআই-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।