মেহজাবিন চৌধুরী :
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই যাত্রী ও এয়ারলাইন্সগুলোর। দক্ষ জনবলের অভাব, লাগেজ পেতে বিড়ম্বনা, লাগেজ কাটা, মূল্যবান মালামাল চুরি, যাত্রীসেবা নিশ্চিত না করা, এয়ারলাইন্সগুলোকে পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় জনবল সরবরাহ করতে না পারাসহ অভিযোগের শেষ নেই। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্বে থাকা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বিষয়গুলো।
এত সব অভিযোগ-অনুযোগ মাথায় নিয়ে আগামী দুই বছরের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজও পেতে যাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। বিশাল অত্যাধুনিক এ টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বিমানের কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য বিমানের পর্যাপ্ত দক্ষ জনবল নেই। বিদ্যমান টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ পরিচালনা করতেই হিমশিম খাচ্ছে বিমান। এ পরিস্থিতিতে বিমানকে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৃতীয় টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া উচিত হবে না।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্র জানায়, চলতি বছরের ডিসেম্বরে শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের শতভাগ অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হবে। এরপর টার্মিনালটি যাত্রীদের জন্য খুলে দিতে আরও এক বছরের মতো সময় লাগবে। এই সময়ে টার্মিনাল পরিচালনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেবে বেবিচক। আর এই পরিচালনার বড় একটি কাজ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং।
বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে যেসব বিদেশি এয়ারলাইন্স ফ্লাইট পরিচালনা করে তারা কেউই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। তৃতীয় টার্মিনালের কাজ চলাকালীন বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ও প্যাসেঞ্জার সার্ভিস নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছিল। জরিপে অংশ নেওয়া ৯৩ শতাংশই বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
বেবিচক জানায়, বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার কারা হবে, তাদের কীভাবে এবং কী কী সার্ভিস দিতে হবে, সেই সার্ভিস দিয়ে রাজস্ব আয় কত হবে— সেগুলো নির্ধারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনকে (আইএফসি) অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রিলিমিনারি রিপোর্টে থার্ড টার্মিনালের প্রাইভেট সেক্টর পার্টনারশিপের (পিএসপি) জন্য পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়ন করা হয়েছিল। তবে, বর্তমানে দুই বছরের জন্য এই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে।
এখন তৃতীয় টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিচালনার সক্ষমতা বিমানের নেই বলে জানিয়েছেন বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) মো. মফিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দরের বিদ্যমান টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এ যাত্রী ও বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর প্রত্যাশা অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারছে না বিমান। সে জায়গায় নবনির্মিত তৃতীয় টার্মিনাল অনেক আকাঙ্ক্ষার। এ টার্মিনালে সবাই আন্তর্জাতিক মানের সেবা প্রত্যাশা করে। তাই পিপিপির মাধ্যমে আইএফসির পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ে প্রাথমিক প্রতিবেদনে একাধিক প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করেছে। যাতে সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভালো সেবা নিশ্চিত করতে একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অনেক বিমানবন্দরে একাধিক প্রতিষ্ঠান গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করে। সে জায়গায় শুধু বিমান দিয়ে তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনা করা সম্ভব নয়। বর্তমানে তৃতীয় টার্মিনাল পরিচালনায় বিমানের ক্যাপাসিটি নেই। এ কাজের জন্য নতুন কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছে সংস্থাটি। তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কারণ, তৃতীয় টার্মিনালে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে যাত্রীর পাশাপাশি কার্গো সুবিধা রাখা হয়েছে। এগুলো পরিচালনায় বিমানের সক্ষমতা নেই।’
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, ‘বিমান আমাদের ন্যাশনাল ক্যারিয়ার। আমাদের বিশ্বাস, তারা সুনামের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করতে পারবে। এরই মধ্যে তারা অনেক যন্ত্রপাতি কিনেছে, দক্ষ জনবলও নিয়োগ দিচ্ছে। আর বিমানের বর্তমান প্রশাসনও অনেক দক্ষ ও আন্তরিক।’
বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো জানায়, নিয়মিত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ দিলেও বিমান পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে পারছে না। ফ্লাইট অবতরণের পর ও উড্ডয়নের আগে অনেক অনুরোধ করে বিমানের পর্যাপ্ত কর্মী পাওয়া যায় না। এজন্য উড়োজাহাজে ব্যাগেজ পৌঁছাতে দেরি হয়। ফলে এয়ারলাইন্সগুলো সময়মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারছে না। আবার ব্যাগেজ বেল্টে দেরিতে লাগেজ দেওয়ায় যাত্রীরা এয়ারলাইন্সের ওপর ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এতে অনেক এয়ারলাইন্সের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।
বিদেশি একাধিক এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, শাহজালাল বিমানবন্দরে একটি ফ্লাইট উড্ডয়ন ও অবতরণে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে দুই হাজার ২শ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়। আর কার্গোর জন্য প্রতি কেজিতে অতিরিক্ত শূন্য দশমিক শূন্য সাত সেন্ট (মার্কিন ডলার) চার্জও দিতে হয়। এসব ব্যয় সত্ত্বেও বিমান তাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের জন্য মাত্র দুই থেকে তিনজন কর্মী সরবরাহ করে। ফলে প্রতিটি এয়ারলাইন্সকে বিমানবন্দরে গড়ে ২৫ জন করে নিজস্ব কর্মী নিয়োগ করতে হয়। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ব্যয় বাড়ছে।
বিশিষ্ট অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার এ টি এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিমান তৃতীয় টার্মিনালের কাজ নিতে চায়। কিন্তু তারা কাজটা করতে পারবে কি না, এটা প্রশ্ন। বিমানের আগের এমডি অনেক যন্ত্রপাতি কিনেছেন। এবং বলেছেন, তারা তৃতীয় টার্মিনালে সেবা দিতে সক্ষম। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। যারা বিমানের অংশীজন, তারা সেবায় সন্তুষ্ট নয়। এই জায়গা থেকে বা কীভাবে ইমেজ সংকট থেকে বের হতে হবে তা কিন্তু বিমান বলছে না। এটা তাদের স্পষ্ট করতে হবে। অন্যথায় তাদের দুই বছরের জন্য গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের দায়িত্ব দিলে রেজাল্ট খারাপ হবে।’
source : jagonews24 and dhakapost.com