সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। দূরের ভবনগুলোতে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।
গাড়ি যখন লালকেল্লার কাছাকাছি পৌঁছালো, প্রায় সবার চোখে-মুখে বিস্ময়। এত উঁচু প্রাচীর, এত বিশাল জায়গাজুড়ে! লাল বেলে পাথর ও ইট দিয়ে তৈরি লালকেল্লা তখন যেন চারপাশে লালিমা ছড়িয়ে দিচ্ছিল।
আগে কখনো যাওয়া হয়নি বলে ধারণা ছিল, হয়তো প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে কয়েকটি ভবন মিলিয়েই লালকেল্লা। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা পেরিয়ে বাস যখন কেল্লার ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল, তখন মনে হলো—এতো এক নগরের মধ্যে আরেক নগর! হবেই বা না কেন, এই কেল্লাই তো দীর্ঘ সময় ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। যেখানে থাকতো রাজপরিবার।
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে আসা বলে কেল্লা পরিদর্শন দ্রুত শেষ করার তাড়া ছিল। গাড়ি থেকে নেমেই সবাই জোর কদমে এগোতে থাকলো। কেল্লার প্রধান প্রবেশদ্বার পার হলে বাজার। দুই পাশে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। বাজার পেরোলে স্বাধীনতা সংগ্রাম জাদুঘর। প্রাচীন অস্ত্র-তলোয়ার, যুদ্ধ সরঞ্জাম ও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু স্মারক সংরক্ষিত রয়েছে এই জাদুঘরে।
এরপর খোলা এক সবুজ প্রাঙ্গণের পাশে দিওয়ান-ই-আম ভবন। তিন পাশ খোলা রেখে এক পাশে ভবনটি। এখানে রাখা সিংহাসনে বসে জনসাধারণের জন্য দরবার বসাতেন সম্রাট। সেখানে তাদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন তিনি। গোধূলি লগ্নে জ্বলে ওঠা রঙিন বাতি দিওয়ান-ই-আমকে তখন এক ভিন্ন রূপ দিয়েছে।
তারপর রঙমহল ভবন, যার সামনে পুকুর এবং ওই পুকুরের মাঝে শোভা পাচ্ছে ফোয়ারা। এখানে রাজপরিবারের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। এ ভবনের পাশেই খাসমহল, যেটা সম্রাটের একান্ত জায়গা। তার অনুমতি বাদে এখানে কারো প্রবেশাধিকার ছিল না।
খাসমহলের পাশে দিওয়ান-ই-খাস। যেখানে কেবল রাজপরিবার ও তার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রবেশাধিকার থাকতো। এই ভবনের সঙ্গে আছে স্নানঘর বা গোসলখানা। খানিকটা দূরে মোতি মসজিদ। তার কিছুটা দূরে নহর-ই-বেহেশত বা স্বর্গের জলধারা।
তাড়াহুড়োর মধ্যেই দূর থেকে হায়াত বকশবাগ, জাফরমহল, হীরামহলসহ কিছু স্থাপনা দেখিয়ে দিচ্ছিলেন সহযাত্রী। পরিচিত করিয়ে দিলেন মুমতাজমহলের সঙ্গে, যেটা ছিল সম্রাজ্ঞী এবং সম্রাটের অন্য স্ত্রীদের মহল।
প্রায় সব স্থাপনায়ই পার্সিয়ান, মুঘল, ইউরোপীয় ও হিন্দু স্থাপত্যকলার অপূর্ব নির্মাণশৈলীর সমন্বয় দেখা যায়। বিশেষ করে শ্বেতপাথর ও লাল বেলে পাথরের স্থাপনাগুলো এখনো আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে বলে যাচ্ছে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের গল্প।
ইতিহাস বলছে, মুঘল সম্রাট শাহজাহান ১৬৩৮ সালে এ কেল্লার নির্মাণকাজ শুরু করেন। শেষ হতে সময় লাগে ১০ বছর। এই দুর্গের প্রাথমিক নাম ছিল ‘কিলা-ই-মুবারক’। অনেকে মনে করেন, লাল রঙের সুরম্য প্রাচীরের কারণে এটি পরে লালকেল্লা নামে রূপ নেয়। ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত এ দুর্গ ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। পরে এই দুর্গ ব্রিটিশ শাসকদের হাতে চলে যায়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল অবধি এটিকে সামরিক ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে ব্রিটিশরা।
লালকেল্লা দর্শনকালে কোথাও রঙিন আলোর ঝলকানি, কোথাও আধো আলো—এর মধ্যেই স্মার্টফোনে মুহূর্তগুলো বন্দি করছিলেন আগত দর্শনার্থীরা। অনেকে করে নিচ্ছিলেন ভিডিও। কেউ কেউ আফসোস লুকাতে পারছিলেন না—সময় করে এলে হয়তো গোটা লালকেল্লা ভালোভাবে দেখা যেতো।
শুরুতে কেল্লার লাহোরি গেট সংলগ্ন স্থানে গাড়ি যাওয়ার পর এক সহযাত্রী বলছিলেন, সামনের এ জায়গাটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেল্লার ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিবছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। সামনের ময়দানে অনেক রাজনৈতিক কর্মসূচিও পালিত হয়। যদিও ওই ময়দানে তখন মেলা চলছিল।
কেল্লার চারপাশে প্রাচীর ঘেঁষে পরিখা দেখে কৌতূহল হচ্ছিল। ইতিহাসের তথ্য তুলে ধরে আরেক সহযাত্রী বলছিলেন, ২৫০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে বিস্তৃত লালকেল্লাকে ঘিরে আছে প্রায় আড়াই কিলোমিটার এ লম্বা প্রাচীর। নিরাপত্তার স্বার্থে প্রাচীর ঘেঁষে এই পরিখা খনন করে তাতে পানির প্রবাহ রাখা হতো, যাতে কেউ চাইলেই সহজে প্রাচীর টপকে কেল্লায় ঢুকতে না পারে।
বর্তমানে লালকেল্লা ভারতের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। ২০০৭ সালে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।